সুনামগঞ্জ , বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪ , ১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
টাঙ্গুয়ার হাওরে অবৈধ জাল জব্দ, আটক ১৬ জামালগঞ্জে বিআরডিবি’র সভাপতি পদে নির্বাচন সম্পন্ন এইচপিভি টিকাদান ক্যাম্পেইন উপলক্ষে প্রেস কনফারেন্স ডিমের নতুন দাম নির্ধারণ সরকারি ঘরের জামানতের কথা বলে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পাসের হারে সিলেটের চমক যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরে গেলেন সেনাপ্রধান সাগর-রুনি হত্যা : ১১২ বার পেছাল তদন্ত প্রতিবেদন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ভিডিও ও স্থিরচিত্র জমা দেওয়ার আহ্বান ঘর দেয়ার কথা বলে ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গ্রেফতার বাজারে সবজি সংকট, ডিম ‘উধাও’ কাঁচামরিচের কেজি ৬০০ টাকা! মানবিক ভিসা চালু করতে যাচ্ছে পর্তুগাল তারেক রহমানের সব মামলা প্রত্যাহার না হলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি সালমান-আনিসুল-পলক-মামুন আরও ৪৭ মামলায় গ্রেফতার শান্তিগঞ্জে যাত্রীছাউনির অভাবে মানুষের ভোগান্তি আজ এইচএসসি’র ফল প্রকাশ নাইকো মামলা: খালেদা জিয়াসহ আট জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ২২ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে পুরুষদের বয়সসীমা ৩৫, নারীদের ৩৭ করার সুপারিশ ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছাত্র-জনতাকে হয়রানি করা হবে না

উন্মত্ততা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে : রাজেকুজ্জামান রতন

  • আপলোড সময় : ২২-০৯-২০২৪ ১১:৫৩:৫০ পূর্বাহ্ন
  • আপডেট সময় : ২২-০৯-২০২৪ ১১:৫৩:৫০ পূর্বাহ্ন
উন্মত্ততা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে : রাজেকুজ্জামান রতন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নৃশংসতা ঘটল তা শুধু ভাবিয়ে তুলেছে তাই নয়, কাঁপিয়েও দিয়েছে দেশের মানুষের বিবেক। বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। সেখানে কি উচ্চতর দায়বোধের জন্ম এবং চর্চা হবে না? ছাত্ররা কি শুধু সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবে? কেমন করে পারে তারা এতটা নির্মম হতে? মারতে মারতে তোফাজ্জলকে অজ্ঞান করে ফেলা হয়েছে। তারপর পানি খাওয়ানো হয়েছে। একটু পরে জ্ঞান ফিরলে উপস্থিত সবাই নাকি হাততালি দিয়ে উঠেছে। প্রত্যক্ষদর্শী একজন বলেছেন, এই হাততালি জ্ঞান ফেরার জন্য কিংবা মরে যায়নি এই জন্য নয়। আবার পেটাতে পারবে এই খুশিতে। এরপর ভাত খাইয়ে আবার তাকে পেটানো হয়, মরে না যাওয়া পর্যন্ত। এই কথাগুলো পড়ার পর কেমন লাগতে পারে একজন পাঠকের? এক বিপুল গণজাগরণের ফলে স্বৈরাচারী শাসকের ক্ষমতার অবসান, পদত্যাগ ও দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। মানুষের আকাক্সক্ষা শুধু শাসকের বিদায় নয়, শাসনব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে গণতন্ত্রহীনতা তারও অবসান ঘটানো। বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে কত আন্দোলন হয়েছে। শাসক দলের নিপীড়ন, পুলিশ বাহিনী দ্বারা মিথ্যা মামলা, হয়রানি, হেফাজতে মৃত্যু, কথিত ক্রসফায়ারের নামে হত্যার বিরুদ্ধে মানুষের কত বেদনার কথা বলা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য, দমনপীড়ন, দুর্নীতি, দুঃশাসনবিরোধী আন্দোলন করেছে মানুষ। এসব আন্দোলনের মিলিত রূপ ছিল ছাত্র শ্রমিক জনতার অভ্যুত্থান। পুরনো পথে যখন আর চলা যায় না তখনই মানুষ নতুন পথের সন্ধান করে। অবরুদ্ধ মানুষ মুক্তি চায়। আন্দোলন করে, লড়াই করে, মুক্তির জন্য মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে পথে নামে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। ফলে আন্দোলনে তৈরি হয় জন-আকাক্সক্ষা। সে আকাক্সক্ষা অবশ্যই পুরনো ব্যবস্থা পাল্টে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তনের। এবং অবশ্যই আরও উন্নততর। কিন্তু যা হচ্ছে তাতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে। একটা কথা চালু হয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, যা চলছে তা হলো ‘মব জাস্টিস’। কোনো সাক্ষী নেই, প্রমাণ নেই, ক্ষোভ আছে আর অভিযোগ আছে। ব্যস ধর, মার, পুড়িয়ে দাও, জ্বালিয়ে দাও। একটা হল্লা তৈরি করলেই হলো, জড় হয়ে যায় উত্তেজিত মানুষ। তারাও জানতে চায় না, শুনতে চায় না, তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ তো দূরের কথা ন্যূনতম ধৈর্য নেই, কারও মতামতের তোয়াক্কা বা অপেক্ষা করে না। আইনের ধার ধারে না। উত্তেজিত জনতার কাছে তার নিজের ধারণাই প্রধান। সাক্ষী প্রমাণ নেই, নিজের ধারণাই প্রমাণ। কাউকে ধরতে পারলে তখন প্রতিযোগিতা চলে কে কত বেশি মারতে পারে। সুতরাং হাতের কাছে পেয়েছ যখন, পিটাও, পিটিয়ে মেরে ফেল। কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। উত্তেজিত জনতা তখন ভুলে যায়, কেউ যদি সত্যি সত্যি চুরি করে থাকে, কিংবা প্রতিপক্ষ দলের পা-াও হয়, তাহলেও তাকে মারা যায় না, মেরে ফেলা যায় না। এটা মানবিক কিংবা আইনত কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গড়নটা অদ্ভুত। কোনো ঘটনা স¤পর্কে কিছুই জানেন না, কিন্তু কোথাও কাউকে মারা হচ্ছে, এটা দেখলে আপাত নিরীহ মানুষটাও অনেক সময় গণপিটুনিতে অংশ নিয়ে থাকে। পকেটমার সন্দেহে কাউকে ধরা হয়েছে, বাসের কন্ডাক্টরের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে বচসা, কাউকে ছেলেধরা হিসেবে সন্দেহ হচ্ছে, ব্যস! আর কথা নেই। পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন যিনি, তিনিও অতি উৎসাহে দু-চারটা থাপ্পড়, ঘুসি বা হাতের কাছে যা পান তাই দিয়ে কয়েক ঘা বাড়ি দিয়ে চলে গেলেন। পরে আর খোঁজও নিলেন না যাকে মেরে এলেন সে হতভাগা বেঁচে আছে না মরে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে মারার সাহস নেই, কিন্তু মনের মধ্যে রাগ আছে, কাউকে পেটানোর ইচ্ছা আছে এসব মানুষের জন্য এ ধরনের গণপিটুনিতে অংশ নেওয়ার ঘটনা অনেক। ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই অথচ ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটানোর সুযোগ। এসব দায়হীন অপরাধ। সবাই মিলে মারলে দায় কারও একার থাকে না। এই সুযোগ নেয় কেউ কেউ। নির্মম আক্রোশে পিটিয়ে মেরে ফেলে যাকে সেও বুঝতে পারে না এত মানুষ কেন তাকে মারছে। যে মরে যায় সে একটা জিজ্ঞাসা রেখে যায়, যারা তোমরা আমাকে মেরে ফেললে, তোমাদের মধ্যে যে একটা মানুষ থাকার কথা ছিল, সেই মানুষটা কি বেঁচে থাকল? সবাই যখন জনতা তখন মামলা হবে কার বিরুদ্ধে? কার আঘাতে মৃত্যু হয়েছে তা নির্ধারণ করা যায় না বলে আসামিরও ঠিক-ঠিকানা থাকে না। পুরো বিষয়টাই তখন সাধারণ হয়ে যায়, উচ্ছৃঙ্খল জনতার প্রহারে মৃত্যু এই শিরোনামের খবর প্রচারিত হয়। উচ্ছৃঙ্খলতার নামে আড়াল হয়ে যায় অমানবিকতা। এর পরিণতি কি ভালো হবে; ভালো হয় কিংবা ভালো হয়েছে কখনো? উত্তেজিত জনতা এতটাই উন্মত্ত থাকে যে, তারা আইনকানুন বা নীতি নৈতিকতার ধার ধারে না। কিন্তু যাদের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সেই সরকার বা প্রশাসনের নৈতিক দায়হীনতা যে ভয়ংকর পরিণতি বয়ে আনতে পারে, তা কি তারা ভাববেন না? ভাবতে অবাক লাগে, তিন-চার ঘণ্টা ধরে মারধর করা হচ্ছে কোনো প্রশাসন নেই? মারধর করার ভিডিও যারা দেখেছেন তারা সবাই বলেছেন এই নিষ্ঠুরতা মেনে নেওয়া যায় না। প্রশ্ন তুলছেন, এতটা অমানবিক হতে পারল কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছাত্র? ঠিক এমনই প্রশ্ন উঠেছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার হত্যার পর। তাহলে কি পাল্টানোর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না, পাল্টাপাল্টিই চলতে থাকবে? মননজগৎ অধিকার করে থাকবে হিং¯্র মানসিকতা? প্রশাসনে অস্থিরতা আছে এবং পুলিশ শতভাগ সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি, এটি কি কোন অজুহাত হতে পারে? এই অজুহাত গ্রহণযোগ্য হলে সামাজিক নৈরাজ্য একটা যুক্তির আশ্রয় পেয়ে যায় এবং সুযোগ সন্ধানীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। ফলে দুর্বল সরকারকেও আইনের প্রয়োগ করতে হয়, সামাজিক শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য। রাজনৈতিক আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা আর মানুষ নির্যাতন করতে আইনের তোয়াক্কা না করা যে এক বিষয় নয়, সে ধারণাটাও স্পষ্ট করা দরকার। কে করবে এটা, করবে সরকার, দায় নিতে হবে তাকেই। মব জাস্টিসের নামে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো তো কোনোভাবেই জাস্টিস বলা চলে না। এগুলো হচ্ছে মব ভায়লেন্স বা মব লিঞ্চিং। কেউ উত্তেজিত হয়ে বা কাউকে উত্তেজিত করে একত্রিত হলো, তারপর কাউকে চিহ্নিত করে পাকড়াও করে মারতে শুরু করল। এ রকম ঘটনাকে কি জাস্টিস বলা যাবে? বিচারের তো একটা ন্যূনতম মানদ- থাকে। দুপক্ষের কথা শুনতে হয়। একজন যা ভাবলেন সেটাকেই সঠিক ভেবে কাজ করলে তো সেই স্বেচ্ছাচারী মানসিকতারই চর্চা করা হবে, যার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই, এত জীবনদান। উত্তেজিত এবং একত্রিত হয়ে কাউকে দায়ী করে ধরে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার মধ্যে তো এই ব্যাপারটাই থাকে যে, যারা অভিযোগকারী, তারাই হলেন বিচারকারী এবং তারাই শাস্তি প্রদানকারী। তাহলে বিচারের নামে প্রহসন বা বিচারহীনতার সংস্কৃতি কি স্থায়ী হয়ে যায় না? অতীতের ঘটনাগুলো তো বটেই; অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো যদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হয় এবং মানুষের মানবিক বোধ জাগিয়ে তোলার পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়বে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে চিহ্নিত দোষীদের গ্রেপ্তার এবং আইনের আওতায় না আনা হলে এই কথিত মব জাস্টিস সংক্রামক হয়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। দেশের পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে কিংবা ‘পুলিশকে বলে লাভ নেই’, পুলিশ কিছু করবে না, যা করার আমরাই করব এই যুক্তি দিয়ে তাৎক্ষণিক বিচার এবং শাস্তি প্রদানকারী জনতাকে কি ‘মব জাস্টিস’ বা ‘উন্মত্ত জনতার বিচার’ বলা যাবে? ‘জাস্টিস’ কথাটার আক্ষরিক অর্থ ‘ন্যায়বিচার’, সেহেতু এসব ঘটনাকে ‘মব জাস্টিস’ বলে উল্লেখ করলে তা কি এক ধরনের ন্যায্যতার উপাদান খুঁজে পেতে পারে না? এর ফলে কি এগুলোকে আর অপরাধমূলক হত্যাকা-, হত্যা, নৃশংসতার পর্যায়ে না ফেলে কিছুটা যুক্তিগ্রাহ্যতার মোড়কে আড়াল করা হয় না? ফলে ঘটনাকে আড়াল করা নয়, কোনোভাবে যুক্তিসংগত করার চেষ্টা করা নয়, অন্তরালের কারণ উ™ঘাটন ও তার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। গণতন্ত্রের আশা যেন আতঙ্কের মেঘে ঢাকা পড়ে না যায়। এসব জন-উন্মত্ততার এবং নিষ্ঠুর হত্যার কারণ যেমন খুঁজে বের করা দরকার তেমনি এর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ জরুরি। একই সঙ্গে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন। প্রতিশোধের আগুন শুধু প্রতিপক্ষকে পুড়িয়ে দেয় না, নিজের ঘরে আগুন লাগার শঙ্কাও তৈরি করে। এসব শঙ্কা যে অমূলক নয়, অতীতের বহু ঘটনায় তার প্রমাণ আছে। এ ধরনের ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। যার খেসারত দিতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, “মানুষের মরণ আমাকে বড় আঘাত করে না, করে মনুষ্যত্বের মরণ দেখিলে।” আমরা কি মনুষ্যত্বের মরণ দেখব, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে মনুষ্যত্বের জাগরণ দেখব। বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যৎ রচনা করা তরুণ যুবকরা কি ভয়ের সংস্কৃতির বিপরীতে ভরসা জাগানিয়া পদক্ষেপ নেবে না? এই প্রশ্ন এখন দেশের মানুষের। লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha

কমেন্ট বক্স
প্রতিবেদকের তথ্য